স্বদেশ ডেস্ক:
দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে দলের অবস্থান কী হবে- তা ঠিক করতে যাচ্ছে বিএনপি। ভারত ও চীনের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ইস্যুতে কোন রাষ্ট্রের নৈতিক ভূমিকায় কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেওয়া হবে, তারও একটি ব্যাকরণ দলটি ঠিক করবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^রচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিএনপি সব সময়ই দেশ ও জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতি করে। দেশে এ মুহূর্তে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার নেই। ফলে এই ইস্যুতে বিশে^র সব রাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়াবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।’
নীতিনির্ধারণী সূত্র মতে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থান স্পষ্ট বলে মনে করে বিএনপি। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া একসময়ের বন্ধু দেশ চীন ও সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের সাথে বিএনপির সম্পর্ক এখন তলানির দিকে। ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে তা বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে দলটি। এ অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর ব্যাপারে কী অবস্থান নেওয়া উচিত, তা নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে বিস্তারিত আলোচনা করতে যাচ্ছে দলটি। এরই অংশ হিসেবে আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠেয়
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভারত ইস্যুতে খোলামেলা আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারতের ভূমিকাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা উঠে আসে। ভারত বা অন্যান্য দেশ নিয়ে বক্তব্য কী হওয়া উচিত তা নিয়ে কথা ওঠে। ভারত ইস্যুতে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত এলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তবে একজন নেতা বলেন, ২০০৮ সাল থেকে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, প্রতিটিতে ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ২০১৪ সালের পর ভারত-বিরোধিতা বন্ধ করে দেয় বিএনপি। তাতেও কাজ হয়নি। এ অবস্থায় দলটি ভারতের প্রতিটি নীতি ও কর্মকা-ের সক্রিয় সমালোচনা করে বক্তব্য দেবে। তবে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করার জায়গা ঠিক রেখেই বিরোধিতা করবে বিএনপি।
এদিকে গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর চীনসহ কয়েকটি দেশের সাথে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বৈঠক হয়েছে। একজন নেতা বলেন, তাদের কাছে মনে হয়েছে, বিএনপির বিষয়ে চীনের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তবে ভারতের মনোভাব সরকারের দিকেই রয়েছে।
এ অবস্থায় সরকারবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবিশেষ ভারতীয় পণ্য বর্জনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। এটি দেশে ও দেশের বাইরে প্রবাসীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিএনপি এ নিয়ে চুপ থাকলেও এই ক্যাম্পেইনের সাথে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ব্যক্তিগতভাবে সংহতি জানিয়ে নিজের গায়ের চাদর ছুড়ে ফেলেন যেটি ছিল ভারতের তৈরি। এ প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারতের ভূমিকার কারণে ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে যে সামাজিক আন্দোলন তৈরি হয়েছে তাতে আমি সংহতি প্রকাশ করেছি। এটি দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। ভারতীয় নীতিনির্ধারক ও কূটনীতিকরা যেভাবে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে এটি সামাজিক প্রতিবাদে অংশ নেওয়া।’
রুহুল কবির রিজভীর ভারতীয় পণ্য বর্জন ক্যাম্পেইনের সাথে সংহতি জানানোর পর সাধারণ নেতাকর্মীদের মাঝে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মাঝে ভিন্নতা রয়েছে। তবে তারা কেউ এ নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেননি। দলের একজন নেতা বলেন, ‘রুহুল কবির রিজভী যা করেছেন, তা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনার বাইরে করেছেন- এমন মনে হয় না। তারা বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছেন।’
এ বিষয়ে বিএনপির একাধিক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, বিশ^ রাজনীতি এমন এক জায়গায় অবস্থান করছে যে ক্ষণে ক্ষণে তা পরিবর্তিত হচ্ছে। কখন কোন দেশ কার বন্ধু বা শত্রু হচ্ছে- এই হিসাব মাথায় রেখেই আমাদের আগামীর পথ চলতে হবে। সেক্ষেত্রে দলের একটি নিজস্ব ব্যাকরণ থাকা দরকার। চাইলেই কোনো দেশের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া যায় বা বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকা যায়। আবার জনপ্রিয়তা থাকলেই ক্ষমতায় যাওয়া যায় না- বিএনপি তার বড় প্রমাণ। জনপ্রিয় দল হওয়া সত্ত্বেও পলিসিগতভাবে মার খাওয়ার কারণে গত ১৭ বছর ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে।
এ অবস্থায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘সব কিছু বদলাতে পারলেও প্রতিবেশী পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। আমরা এই গণতান্ত্রিক প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক সব সময় ভালো রাখতে চাই। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা করায় দেশে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভোটাধিকার হরণ হয়েছে। তাই দেশের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। জনগণের দল হিসেবে বিএনপি জনগণের দাবি ও মতামতকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। তাই ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করা।’
দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বারবার একটি বিষয়কে সামনে এনেছে। তা হচ্ছে- বিএনপি ভারতবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক দল। এটা করেই বৈশি^কভাবে বিএনপিকে বন্ধুহীন করা হয়েছে। যার সুবিধা গত কয়েক বছরে পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এখনো প্রভাবশালী দেশ ভারত, চীন ও রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলছে ক্ষমতাসীনরা। আমরা যত সহজে ভারতের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিই, তা হলে গাজায় মুসলিম গণহত্যা চালাচ্ছে যে ইসরায়েল তার বিরুদ্ধে কেন কথা বলছি না? অবশ্যই এখানে আমাদের রাজনৈতিক কোনো কারণ রয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, দেশের বাইরে আমাদের বন্ধু আছে, কোনো প্রভু নেই। কেউ যদি প্রভুত্ব খাটাতে চায়, তা হলে আমরা তার প্রতিবাদ করব। কিন্তু এই প্রতিবাদেরও একটা ব্যাকরণ থাকা প্রয়োজন।